আজকাল ওয়েবডেস্ক: ডিনার টেবিলে পাশাপাশি বসে আছেন স্বামী-স্ত্রী। পাতে ধোঁয়া ওঠা খাবার, কিন্তু দু’জনের চোখই সামনের মোবাইল স্ক্রিনে। দিনের শেষে একে অপরের সঙ্গে দু’টো কথা বলারও যেন ইচ্ছে নেই। বাইরে থেকে দেখলে এঁরা এক ‘সুখী’ দম্পতি। একই ছাদের নীচে বাস, সামাজিক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে যোগদান- সবই নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু এই আপাত স্বাভাবিকতার আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর শূন্যতা। সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা একেই বলছেন ‘ইমোশনাল ডিভোর্স’ বা মানসিক বিচ্ছেদ।

‘ইমোশনাল ডিভোর্স’ কোনও আইনি পরিভাষা নয়, এটি একটি মানসিক অবস্থা। যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার আবেগ, অনুভূতি, স্নেহ, বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার সেতুটি পুরোপুরি ভেঙে যায়, কিন্তু সামাজিক বা পারিবারিক কারণে তাঁরা একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হন, সেই অবস্থাকেই মানসিক বিচ্ছেদ বলা হয়। এক্ষেত্রে শরীরী উপস্থিতি থাকলেও মনের যোগসূত্রটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। তাঁরা তখন দম্পতির বদলে দু’জন রুমমেট বা একই ছাদের তলায় বাস করা প্রতিবেশীতে পরিণত হন।

কীভাবে বুঝবেন আপনি মানসিক বিচ্ছেদের শিকার?

মনোবিদদের মতে, এর কয়েকটি সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে যা নীরবে একটি সম্পর্ককে শেষ করে দেয়।

কথাবার্তার অভাব: দৈনন্দিন প্রয়োজন বা সন্তানদের বিষয় ছাড়া নিজেদের মধ্যে কোনও কথাই হয় না। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, ভয় বা স্বপ্নের কথা ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছেটাই মরে যায়।

উদাসীনতা: সঙ্গীর প্রতি কোনও অভিযোগ বা অভিমানও আর থাকে না। ঝগড়া করার মতো মানসিক শক্তি বা ইচ্ছেও অবশিষ্ট থাকে না। তাঁর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি- কোনও কিছুতেই যেন আর কিছু যায়-আসে না।

সমান্তরাল জীবনযাপন: দু’জনে একই বাড়িতে থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন কাটান। দু’জনের বন্ধুবান্ধব, জগৎ, ভাল লাগা- সবই আলাদা। একে অপরের জীবনে কার্যত অতিথির ভূমিকা পালন করেন।

আবেগের আশ্রয় অন্যত্র খোঁজা: মানসিক শান্তির জন্য বা নিজের কথা বলার জন্য সঙ্গীর বদলে অন্য বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

কেন বাড়ছে এই প্রবণতা?

সমাজতত্ত্ববিদ এবং মনোবিদদের মতে, এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। বহুদিনের জমে থাকা চাপা ক্ষোভ, বিশ্বাসভঙ্গ, একে অপরকে অতিসাধারণ বলে ধরে নেওয়া এবং সর্বোপরি ‘লোকে কী বলবে’ বা ‘সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে’ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সামাজিক চাপ- এই সবকিছুই মানসিক বিচ্ছেদের পথ প্রশস্ত করে। শারীরিক নির্যাতনের মতো এর কোনও দৃশ্যমান ক্ষত থাকে না বলে এই সমস্যাকে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এই নীরবতা একটি মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে ভিতর থেকে শেষ করে দেয়।

যে দাম্পত্যে ভালবাসা বা সম্মান অবশিষ্ট নেই, কেবল অভ্যাসের টানে বা বাধ্য হয়ে সেই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো হয়, তা আইনি বিচ্ছেদের চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। এই ধরনের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। প্রথম পদক্ষেপ হল সমস্যাটিকে স্বীকার করা। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যেতে পারে। কারণ একটি মৃত সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর চেয়ে সম্মানের সঙ্গে তার ইতি টানা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।